একজন শিক্ষক ও কবি রাজীব মীর
রাকিব হাসান :
রাজীব মীর। আমার শিক্ষক। প্রচন্ড আবেগী একজন মানুষ। তাকে নিয়ে তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। সম্ভবত এসবের মাঝে থাকতেই ভালবাসেন তিনি। তবে এটাও সত্য সকল বিতর্ক ছাপিয়ে রয়েছে তার কিছু মানবীয় গুণ। যা তাকে করে তুলেছে অনন্য। নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করেই যে কারো বিপদে নিদ্বিধায় ছুটে যান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়েকজন শিক্ষক; যেকোনো কন্টেন্ট নিয়ে একটু ভিন্ন এঙ্গেলে চিন্তা করার বীজ বপন করেছিলেন তিনিও তাদের একজন। তাঁকে আমি বলি কথার জাদুকর ও একই সাথে ভালবাসার কারিগর। কেননা ভালবাসার স্বরূপ জানতে এতটা মরিয়া হতে আর কাউকে কখনও দেখিনি।‘ভালবাসা’ শব্দটির কত রূপ, রস, ধরণ, সৌরভ তা নিয়ে জল্পনা, কল্পনা, গবেষণারও অন্ত নেই তাঁর।
শিক্ষক হিসেবেও তিনি জনপ্রিয়। ক্লাসের সবচেয়ে অস্থির ছেলেটিকেও তন্ময় হয়ে ‘নান্দনিক যোগাযোগ’ বিষয়ে ৩ ঘন্টার ম্যারাথন ক্লাস উপভোগ করতে দেখেছি। হ্যামিলিওনের বাঁশিওয়ালার মতো মন্ত্রমুগ্ধ করে টেনে নিয়ে যাওয়ার অদ্ভূত এক সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে, যা তাঁর চিরশত্রুও নিদ্বিধায় মেনে নেবেন।
নীতি ও আদর্শগত নানা মতানৈক্যের কারণে রাজীব মীরের সবচেয়ে কড়া সমালোচক আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সম্পর্কের অবনতিও হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য কোনো শিক্ষক যদি আমার কাছ থেকে অনেক বেশি কষ্ট পেয়ে থাকেন সেটাও তিনি। অথচ এর কোনো প্রভাব পড়েনি পরীক্ষার খাতায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, কয়েকজন মানুষ আমাকে প্রচন্ড সম্ভাবনাময়ী হিসেবে দেখেন এবং উচ্চ ধারণা পোষণ করেন; তাদের মধ্যে অন্যতম রাজীব মীর।
স্পষ্টবাদী ও একরোখা স্বভাবের কারণে অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেছে। কিন্তু এক অপার্থিব অদৃশ্য বন্ধনে স্যারের সাথে এখনও সম্পর্ক অটুট আছে। যখন আত্নবিশ্লেষণ করি- অবাক হই। নানা মতভিন্নতা স্বত্ত্বেও দুই মেরুর দুটি মানুষের মাঝে যোগাযোগ অটুট থাকে কী করে? ভেবে পাই না ! যোগাযোগের বিভিন্ন থিওরিতে ফেলে বিশ্লেষণ করেও এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন এটা -‘কনট্রাস্ট এন্ড ব্যালেন্স’ ছাড়া আর কিছু নয়!! হয়তো তাই।
এটা বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর বন্ধুসুলভ আচরণ ও আন্তরিকতা বরাবরই কাছে টানে। চবির প্রীতিলতা হলের বিপরীতে একটি বিল্ডিং এর দুতলায় থাকতেন রাজীব মীর। প্রায় গান, কবিতা ও আড্ডার আসর বসতো সেখানে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকায় সে আড্ডা আমাকেও খুব টানতো। এমনও সময় গেছে চাঁদনী রাতে তাঁর বাসার ছাদে রাতভর আড্ডা দিয়ে ফজরের নামায পড়ে ঘুমাতে গেছি। বন্ধু আল-আমিন, শফিক, কামালসহ আরও অনেকেই থাকতো সেসব আড্ডায়।
এখনোও স্পষ্ট মনে আছে; ২০০৩ সালে ক্লাসে উপস্থিতি না থাকার কারণে বন্ধু বাবুর শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছিলো; তখন ওর জন্য বিভাগের চেয়ারম্যান আলী আসগর স্যারকে লেখা রাজীব মীরের আবেগপূর্ণ চিঠি আমার মনোজগতকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। কারণ তা কোনো সাধারণ চিঠি ছিলো না। চিঠি পড়ে শুধু বলেছিলাম ‘স্যার গদ্যটা আপনার জন্য’। যদিও ভালোবাসা প্রকাশে পদ্যকেই যুতসই মনে করেন তিনি।
এ পর্যন্ত রাজীব মীরের বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে ‘তোমার জন্য লিখি’ এবং ‘প্রেমে পড়েছে পাথর’ দুটি কাব্যগ্রন্থ। ২য়টি এখনও পড়া হয়নি। তবে আমি আশাবাদী তাঁর কাব্যগ্রন্থে চমক দেখাবেন কবি রাজীব মীর। কারণ তাঁর ভেতরে ভালবাসা আছে; তিনি ভালবাসতে জানেন। এটাই একজন কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে আমি মনে করি।
কবির প্রতি ভালবাসা জানিয়ে শুধু এটুকু বলবো –
‘অহর্নিশ ভালবাসার মন্ত্রে তোমার ভর
ভাঙা গড়ার খেলায় তুমি-ই কারিগর;
মনের মাঝেই বসত গড়ো, বানের মতোই ভাঙো
ভালোবাসার মানে তো তুমিই কেবল জানো ’!!